'অপারেশন সার্চ লাইট' এর নির্মম পরিকল্পনা মোতাবেক নিরস্ত্র বাঙালি জনতার ওপর আক্রমণের পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার এড়িয়ে কেন আত্মগোপনে যাননি, তা নিয়ে নানা বক্তব্য আছে । কারণ, বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন ২৫শে মার্চের পাকিস্তানী আক্রমণ সম্পর্কে । কিন্তু কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলেন পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে। পাকিস্তানি আক্রমণের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর আশেপাশের সকল সহকর্মীকে তাৎক্ষণিকভাবে শহর ছাড়তে এবং তোফায়েল, রাজ্জাক ও অন্যান্য তরুণ নেতাদের বুড়িগঙ্গার অপর পাড়ে গ্রামের দিকে চলে যাবার নির্দেশ দেন।
রাজনৈতিক সহকর্মীদের আত্মগোপনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে বাসায় অবস্থানের কারণ বঙ্গবন্ধু ব্যাখ্যা করেছেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৮ই জানুয়ারি ১৯৭২ ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, সে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমাণ্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, ওরা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপোসের আলোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে । আমি বাড়ি থেকে বেরুনো, না বেরুনো নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানি বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি স্থির করলাম : আমি মরি, তাও ভাল, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক। ...আমি ইচ্ছা করলে যেকোনো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করবো। মৃত্যুবরণ করবো। পালিয়ে কেন যাব? দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল: তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোল।”
আবার সহকর্মীদের আত্মগোপনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে আত্মগোপনে না যাওয়ার কারণ ২৫শে মার্চ রাতেই তিনি সহকর্মীদের নিকট ব্যাখ্যা করেছেন বলে মওদুদ আহমদ তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। মওদুদের ভাষ্য মতে, শেখ মুজিব বলেন, আমাকে সবাই চেনে। আমাকে গ্রেফতার করা হলে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো বিষয়টি গ্রহণ করবে। কিন্তু তোমাদের কেউ চেনে না। কাজেই তোমাদের অবশ্যই পালাতে হবে।' জে. এন. দীক্ষিতের মতে, শেখ মুজিব ভেবেছিলেন তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। অন্য কারণ হলো, মুজিব আত্মগোপন করলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁর জনগণের ওপর আরও ভয়াবহ অত্যাচারে মেতে উঠবে। গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২৫শে মার্চে সারাদিন বঙ্গবন্ধু প্রচুর লোকজনের সাথে আলাপ করেন। অনেকে তাঁকে বাসা ছেড়ে যেতে বলেন। প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, “যখন একটি জাতির নেতা পালিয়ে যায় তখন ঐ জাতির মনোবল ভেঙে যায়” । সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু নিজে কখনো কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন বা দাবি আদায়ে পিছপা হননি বা পালিয়েও যাননি। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী হিসেবে কারাবরণ করাকেই তিনি যৌক্তিক বিবেচনা করেন।
উল্লিখিত সব তথ্য ও ব্যাখ্যা সঠিক ও যৌক্তিক হিসেবে গ্রহণ করে বলা যায়-রাজনৈতিক সহকর্মী ও বাঙালি জনগণের ওপর বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। তিনি নিশ্চিত ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলন যে পর্যায়ে এসেছে তাতে তাঁর নিজের অনুপস্থিতিতেও সহকর্মীরা এই আন্দোলনকে সফলতায় নিয়ে যেতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে আহমেদ সালিম তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “ভুট্টো এবিষয়ে সচেতন ছিলেন যে, মুজিব শহিদের মৃত্যু বেছে নিয়েছেন এবং তাঁর কবরের ওপর বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবে বলে আশা করেছেন।”
শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা হেফাজতে নেবার পর ১০ই এপ্রিল ঘোষণা করা হলো-শেখ মুজিব তাদের হাতে বন্দি । মূলত ওই ঘোষণা এবং করাচি বিমানবন্দরে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পরই বাঙালিরা তাঁর বেঁচে থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হন এবং স্বস্তিবোধ করতে থাকে। ২৫শে মার্চ রাত একটা থেকে দেড়টার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের তিনদিন পরে ২৯শে মার্চ বিমানযোগে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং লায়ালপুর (বর্তমান ফয়সালাবাদ) জেলে আটক রাখা হয়।
আরও দেখুন...